৯ জানুয়ারী, ২০২৩

আইন কাকে বলে? আইনের বৈশিষ্ট্য কি? এবং বাংলাদেশে আইনের উৎস কি?; Definition, Nature and Sources of Law in Bangladesh


আইন মানুষের জীবনের সাথে জড়িত যা মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই সমাজে, একটি রাষ্ট্রের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে আইনের প্রয়োজন হয়।সাধারণত আইন একটি দেশের সরকার দ্বারা প্রণীত হয়, যা সমাজে কিভাবে আচার-আচরণ করতে হয় তা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন আইন পাওয়া যায়। বাংলাদেশে, বিভিন্ন ধরনের আইন রয়েছে যেগুলি আলোচনা করা হবে।

আইন কাকে বলে? (Definition of Law)

যেহেতু, আইনবিদ এবং নীতিনির্ধারকরা আইনকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, তাই এক বাক্যে আইনকে সম্পূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, জন অস্টিন আইনকে সার্বভৌম ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের আদেশ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

জন অস্টিনের মতে, “Law is a command of the sovereign backed by a sanction.”

অন্যদিকে, কেলসেন মনে করেন যে আইনটি আদর্শ (norm) বা গ্র্যান্ড আদর্শ(grund norm) এর ফলাফল।

সুতরাং, যদি আমরা উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোকে খুব মনোযোগ সহকারে বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে আইন হল একটি সমাজে মানবিক আচরণ ও আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা নিয়মের একটি অংশ যা মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।

তাছাড়া সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে আইনের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের আইনের উৎস গুলি পাওয়া যায়ঃ 

"আইন" অর্থ বাংলাদেশে বলবত যোগ্য কোনো আইন (Act), অধ্যাদেশ (Ordinance), আদেশ (Order), বিধি (Rules), প্রবিধান (Regulations), উপ-আইন (Bye Laws), প্রজ্ঞাপন (Notification) বা অন্যান্য আইনি উপকরণ (Other Instruments) এবং কোনো প্রথা (Customs) বা ব্যবহার (Usages)”

আইনের উৎসঃ আইনের অনেক উৎস আছে। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়সমুহ বিবেচনা করলে বাংলাদেশে আইনের নিন্মোক্ত উৎস গুলো প্রাধান্য পায়ঃ

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধান (Constituion):-

১. সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে-

‘এই সংবিধান জনগণের ইচ্ছার গম্ভীর অভিব্যক্তি হিসেবে, প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সে অন্য আইন, এবং যতটুকু অসামঞ্জস্য  সেপর্যন্ত, বাতিল হয়ে যাবে।’

সাংবিধানইক প্রধান্যের ক্ষেত্রে, সংবিধান সংসদের উপর প্রাধান্য পাবে  এবং সংসদ শুধুমাত্র সংবিধানের সীমার মধ্যে থেকে তার কার্যাবলী প্রয়োগ করতে পারে এবং আইন প্রণয়ন করতে পারে। রাষ্ট্রের সমগ্র আইন প্রণয়ন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম সংবিধানের সীমার মধ্যে নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।

২. কাস্টমস (Customs): সমাজে বহুকাল ধরে প্রচলিত নিয়ম-নীতিকে প্রথা বলে। সময়ের পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রথা আইনের মর্যাদা পায়।

৩. ধর্ম (Religion): প্রতিটি ধর্মের নিজস্ব নিয়ম-কানুন রয়েছে যা মানুষকে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করে। অতীতে যখন আইনের কোনো সংগঠিত প্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন ধর্ম তার ভূমিকা পালন করত। ধর্ম অনুসরণ করা হয়েছিল এবং যে কেউ তা লঙ্ঘন করেছিল তাদের ধর্ম অনুসারে শাস্তি ভোগ করতো। ধর্ম থেকে, ধর্মীয় হুকুম এবং ধর্মীয় বই থেকে কিছু আইনের উদ্ভব হয়েছে যেমন হিন্দু ও মুসলিম আইন । বাংলাদেশে ব্যক্তি ও পারিবারিক ক্ষেত্রে যেমন, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, দেনমোহর, শিশুর অভিভাবক নির্ধারণ সহ বিভিন্ন বিষয়ে যার যার ধর্মীয় আইন প্রযোজ্য হবে।

৪. বিচারিক সিদ্ধান্ত (Judicial Precedent): অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত আইন দিয়ে বিচার করা যায় না। বিদ্যমান আইনগুলো মামলা নিষ্পত্তিতে কম পড়ে। তখন বিচারকরা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য প্রচলিত অস্পষ্ট আইনের ব্যাখ্যা দেন। এইভাবে নতুন আইন তৈরি করা হয় এবং পরবর্তীতে এই আইনগুলি অনুরূপ ক্ষেত্রে একটি নজির হিসাবে নেওয়া হয়। এই আইনগুলোকে বিচারক প্রণীত আইন বলা হয়।

4. রাষ্ট্রকর্তৃক প্রণীত আইন (Statutory Law)/আইনসভা (Parliament/ House of Nation in BD): আধুনিক সময়ে আইনসভা হল আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আইনসভা রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী নতুন আইন তৈরি করে। এই আইনগুলিকে বলে সংসদের আইন বা (Acts of Parliament) (সংবিধানের ৬৫ এবং ৮০ নং অনুচ্ছেদ)। রাষ্ট্রকর্তৃক প্রণীত আইনগুলোর মধ্যে আরেকটি হল, অধ্যাদেশ (Ordinance)। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত আনকে অধ্যাদেশ বলে (সংবিধানের ৯৩ নং অনুচ্ছেদ)। যখন জাতীয় সংসদ বৈঠাকে না থাকে অথবা জাতীয় সংসদ ভেঙে যায়, তখন কোন জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করেন এবং অধ্যাদেশ জারী করার পরবর্তীতে সংসদে উপস্থাপন করে আইন হিসাবে পাশ করতে হয়।    

5. অর্পিত আইন (Deligated Legislation): যে আইন সংসদ কর্তৃক কোন প্রতিষ্ঠান বা বিভাগ বা সরকার কে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রণয়ন করা হয় তা হল অর্পিত আইন। কম সময়, পেশাগত দক্ষতার সাথে কম লোক এবং অনুশীলনের জন্য দ্রুত আইনের প্রয়োজনের কারণে, রাষ্ট্র আইন প্রণয়নের প্রতিনিধিদলের জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্র যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইন প্রণয়নের জন্য জরুরি অবস্থা পেয়েছে কারণ এটি একটি নির্দিষ্ট আইনের উপর নির্ভর করতে পারে না। তাই আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সহজ, দ্রুত ও মসৃণ আইন প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন নির্বাহীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এখন এটি আইনের একটি বিশাল উৎস হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে এ ধরনের আইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বিধি (Rules), প্রবিধান (Regulations), উপ-আইন (Bye Laws), প্রজ্ঞাপন (Notification)। 

6. ইক্যুইটি/সমতা (Equity): এর অর্থ হল সমতার ভিত্তিতে  সবার জন্য  ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে, সমস্ত আইন উপযুক্ত নয়। তাই বিচারককে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এবং কার জন্য কোনটি ন্যায়সঙ্গত তা মাথায় রেখে কাজ করে থাকেন। ইক্যুইটি তাদের জন্য ব্যথানাশক হিসাবে কাজ করে যারা ভুক্তভুগি এবং ভবিষ্যতে প্রতিকার পেতে পারে এবং ইক্যুইটির ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করতে পারে।

বাংলাদেশ কোডঃ সমস্ত আইনি ব্যবস্থার প্রাথমিক অনুমানগুলির মধ্যে একটি হল নাগরিকদের আইনের অ্যাক্সেস থাকা উচিত। বাংলাদেশ গেজেটে আইন প্রকাশ করা হল একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। আরও, বাংলাদেশ আইন (সংশোধন ও ঘোষণা) আইন ১৯৭৩-এর ধারা ৬-এ বিধান করা হয়েছে যে "বাংলাদেশে বলবৎ সংসদের সকল আইন, অধ্যাদেশ এবং রাষ্ট্রপতির আদেশ বাংলাদেশ কোডের নাম ও শৈলীর অধীনে কালানুক্রমিক ক্রমে মুদ্রিত হবে"। বাংলাদেশ কোডে, তাই, বাংলাদেশে কার্যকর সমস্ত প্রণীত আইনের সংশোধিত, অভিযোজিত এবং প্রামাণিক সংস্করণ সহজ ভলিউমে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই আইনগুলির মধ্যে রয়েছে ১৭৯৯ সাল থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আইনগুলি যা বর্তমান সময়ে কার্যকর সংবিধানের অধীনে যোগ্যতা অনুসারে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ দ্বারা জারি করা হয়েছে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ কোড ৩৮ টি খণ্ড নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশ কোডের বর্তমান প্রকাশনাটি ৪২টি খণ্ডে উপস্থাপিত হয়েছে, যার মধ্যে ১৭৯৯ থেকে ৩০ জুন ২০১৪ পর্যন্ত আইনের হালনাগাদ ও সংহিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। হালনাগাদ করার কাজের ফলস্বরূপ, ২০০৭ সালে ৩৮টি খণ্ডে প্রকাশিত বাংলাদেশ কোডটি স্থানান্তরিত করা হয়েছে যা এখন ৪২টি খণ্ড নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশ কোডে অন্তর্ভুক্ত আইনগুলি কালানুক্রমিক ক্রমে সাজানো হয়েছে এবং পরবর্তী আইন দ্বারা এতে করা সংশোধনগুলি নির্দেশ করার জন্য পাদটীকা যুক্ত করা হয়েছে।

 

আইনের বৈশিষ্ট্যঃ একটি আইন নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকে-

১। এটি নিয়ম-কানুনের একটি সেট;

২। এটি মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে;

৩। এটি রাষ্ট্র দ্বারা তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়;

        ৪। এটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থায়িত্ব, স্থিরতা এবং অভিন্নতা আছে;

৫। এটি জোরপূর্বক কর্তৃপক্ষ দ্বারা সমর্থিত;

৬। এর লঙ্ঘন শাস্তির দিকে পরিচালিত করে;

        ৭। এটি জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ এবং সাধারণত এটিকে নিশ্চিত করার জন্য                      লিখিত হয়;

৮। এটি 'সার্বভৌমত্ব' ধারণার সাথে সম্পর্কিত যা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।



শেয়ার করুন

0 comments: